কলকাতা, ৩ ফেব্রুয়ারি: পাশেই যাদবপুর স্টেডিয়াম (কিশোর ভারতী ক্রীড়াঙ্গন)। রেল স্টেশন, নতুন মেট্রো স্টেশন প্রায় হাঁটাপথে। লাগোয়া ইএম বাইপাস দিয়ে হরেক রুটের যাত্রীবাহী বাস। বাইপাস দিয়ে বিমানবন্দরে দ্রুত যাওয়ার সুবিধা। পার্ক, লেক, বর্গাকার পরিকল্পিত আবাসন অঞ্চল।কলকাতা পুরসভার ১০৯ নম্বর ওয়ার্ডে (কলকাতা ৭৫) এ রকম একটা এলাকায় নতুন বাড়ি করতে গেলেই ফাঁপড়ে পড়ছেন নাগরিকরা।
বাড়ি ওঠার আগে থেকেই শাসক দলের স্থানীয় ছেলেরা দাবি করছে তাদের কাছ থেকে নির্মাণ সরঞ্জাম কেনার। জমির মালিক তাতে রাজি না হলে দাবি উঠছে মোটা টাকার। মালিক তাতেও রাজি না হলেই সঙ্কট। অভিযোগ পুলিশ, স্থানীয় নেতা-নেত্রীদের কাছে গিয়েও অনেকে সুবিচার পাচ্ছেন না।
প্রসঙ্গটা আরও বাস্তব হয়েছে অতি সাম্প্রতিক দুটি ঘটনায়। নিজের জমিতে নির্মাণের কাজ করছিলেন এক ব্যক্তি। তাতেও তোলাবাজরা রেহাই দেয়নি। সাহায্য মেলেনি প্রশাসনের। শেষ পর্যন্ত হাইকোর্টের শরনাপন্ন হন ভাঙরের ওই বাসিন্দা। শুক্রবার কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি রাজাশেখর মান্থা নির্দেশ দেন, পোলেরহাট থানা এই ঘটনার এফআইআর রুজু করবে। প্রাথমিক তদন্তের রিপোর্ট দু’সপ্তাহের মধ্যে পেশ করতে হবে আদালতে।
দ্বিতীয়টি দক্ষিণ কলকাতার কাঁকুলিয়ায় (পুরসভার ৯০ ওয়ার্ড) মার্কিন নাগরিক জিষ্ণু নাথের প্রহৃত হওয়ার ঘটনায়। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তণী জিষ্ণুবাবু তাঁর বাড়ির মেরামতির ব্যাপারে স্থানীয় দাবিদারদের হুমকির কাছে নথি স্বীকার না করায় প্রহৃত হয়েছেন। এই নিয়ে জল ঘোলা হচ্ছে। কাঁকুলিয়া বস্তি রাজনীতিকদের বড় স্নেহের জায়গা। তাই অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া শক্ত। আবার জিষ্ণুবাবুও পিছপা হওয়ার লোক নন।
সার্ভে পার্ক বা কাঁকুলিয়াই কেবল নয়, রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলই এখন তোলাবাজদের কবলে। গত বছর প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোডে এক বেকারী মালিক রাজনৈতিক মদতপুষ্ট একদল মাফিয়ার হাতে হেনস্থা হন। এই নিয়েও জল ঘোলা হয়। আপোষ করতে হয় ওই বেকারী মালিককে।
আমেরিকা থেকে ফেরত আসা অনাবাসী ভারতীয় সার্ভে পার্কের অলোক সরকার এই প্রতিবেদককে জানান, “প্রথমেই বলব যে মার্কিন মুলুকে কয়েক বছর থাকলে খুব স্বাভাবিক ভাবেই আইন শৃঙ্খলার প্রতি বেশ খানিকটা শ্রদ্ধা জন্মায়। কারণ ও দেশের সাধারণ মানুষ আমাদের দেশের মানুষের চেয়ে অনেক বেশি আইন মেনে চলেন। আমি উনিশ বছর নিউইয়র্কে ছিলাম। ওখানে সাধারণ কিংবা অসাধারণ সবার জন্য এক নিয়ম। তাত্ত্বিকভাবে আমাদের দেশেও তাই, কিন্তু এখানে বাস্তবে অন্যরকম হয়। কিছু ভুল হয়ে গেলেই ওখানকার তাবড় তাবড় নেতা নেত্রীদের অকপটে ক্ষমা চাইতে দেখেছি। ১৯৯৮ সালে ক্লিনটনকে খোলা টিভিতে দেশের মানুষের কাছে ক্ষমা চাইতে দেখেছি।
ভারতবর্ষে, বিশেষ করে পশ্চিম বঙ্গের জন্য কথাটা একেবারেই প্রযোজ্য নয়। এখানে জোর যার মুল্লুক তার। ব্যতিক্রম ছাড়া রাজনৈতিক ক্ষমতা এবং অর্থের প্রতিপত্তি না থাকলে বেশিরভাগ সময় আইনের সাহায্য মেলে না। যিষ্ণু নাথ মশাই বেশ কিছু বছর ধরে আমেরিকায় আছেন সেজন্য উনি হয়তো ভেবেছিলেন যে এখানেও আইন সবার জন্য সমান ভাবে প্রযোজ্য। এই ঘটনার পর ওনার ধারণা পাল্টে যাবে। তবে মার্কিন দূতাবাস যদি ওনাকে সাহায্য করেন, তাহলে দোষীদের ছাড়া পাওয়া মুশকিল হবে।”
কিন্তু কেন এই সমস্যা? সভ্য কোনও সমাজে কি এরকম পরিস্থিতি আদৌ কাম্য? সার্ভে পার্কে বাড়ি করছেন একটি বেসরকারি সংস্থার প্রযুক্তি-পেশাদার উমাপদ মণ্ডল। তাঁর বক্তব্য, “এটা তো সুস্থ সমাজের লক্ষণ নয়। আমি ব্যাঙ্কের ঋণ নিয়ে বাড়ি করছি। পুরসভা থেকে নকশা মঞ্জুর করিয়েছি। অন্যায় তো কিছু করছি না! তার পরেও মাটি খোঁড়ার আগেই সরঞ্জাম কেনা বা টাকা চেয়ে গোটা চার ফোন এসে গিয়েছে। কাছেই আমার এক বন্ধু বাড়ি করছেন। তাঁকেও ঝামেলায় পড়তে হয়েছে। প্রমোটার এবং সিণ্ডিকেটের একাংশ আমাদের কফিনে শেষ পেরেক পুঁতে দিচ্ছে।”
কী ব্যবস্থা নিচ্ছেন স্থানীয় দাদারা? সার্ভে পার্ক ও সংলগ্ন এলাকায় তৃণমূলের অঞ্চল সভাপতি শিবশঙ্কর বেরা এই প্রতিবেদককে বলেন, “কাজ নেই। দলের ছেলেরা করবেটা কী? বছরভর ওরা দলের জন্য খাটে। ভোট করায়। তাই অনেক সময় অভিযোগকারীকে সুবিচার দেওয়া যায় না। কোনও দলীয় প্রতিনিধিকেও চোখ বুঁজে থাকতে হয়। এটা সত্যিই লজ্জার। আশপাশের তৃণমূলের ৯ জন অঞ্চল সভাপতির মধ্যে ৮ জনকে গত পাঁচ বছরে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। পুরনোদের মধ্যে আমিই টিঁকে আছি। পেশায় আমি ছিলাম শিক্ষক। আমার মেয়ে ডক্টরেট, অধ্যাপক। আমারও বিবেককে পীড়া দেয় অনেক কিছু। কিন্তু বিভিন্ন স্তরে ভাগ বাঁটোয়ারা এখন প্রায় বাধ্যতামূলক হয়ে উঠেছে। আমরা সবাই সত্যি অসহায়।”
সমস্যাটা তো নতুন নয়! বাম আমলেও কি এই জিনিস শোনা যায়নি? নব্বইয়ের দশকে সিপিএমের লোকাল কমিটির সম্পাদক, এর পর দলের পূর্ব যাদবপুর জোনাল কমিটির সম্পাদক এবং জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য ছিলেন স্বপন রায়। তাঁর দাবি, “হ্যাঁ, আমাদের আমলে সমস্যাটা ছিল। তবে খুব কম। অভিযোগ এলে আমাদের ব্যবস্থা নিতে হত। না নিলে দলের ওপরমহলে অভিযোগ গেলে আঞ্চলিক নেতাকে তার জবাব দিতে হত। এখন এসব নেই। আমি যে সময় শাসক দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলাম, ওই সময়কালেই মূলত বাইপাসের দুপাশে নির্বিঘ্নে বড় বড় হরেক প্রকল্প হয়েছে। বড় বিতর্ক উঠেছে কি?সবচেয়ে বড় কথা, অনাচারের সঙ্গবদ্ধ প্রতিবাদটাও উঠে গেছে। ব্যক্তিস্বার্থ অথবা ভয়ে যেন অধিকাংশই সঙ্কুচিত। কিছু সাংবাদিক এর উর্দ্ধে উঠে লেখালেখি করছে বলে বিভিন্ন অনাচারের কথা সবাই জানতে পারছে। অন্যথায় কোথায়, কী হচ্ছে লোকে তো জানতেই পারত না!”
পূর্ব যাদবপুরের কংগ্রেস নেতা সন্তোষপুর নিবাসী পার্থপ্রতীম রায় এই প্রতিবেদককে জানান, “এই ঘটনা তো সমস্ত রাজ্য জুড়েই চলছে। আমরা কলকাতার মানুষ আমরা মোটামুটি অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি। কলকাতা জুড়েই এই রকম অরাজকতা চলছে। এখানে আইনের শাসন নেই। পুলিশ স্থানীয় রাজনৈতিক দাদাদের কথায় ওঠা বসা করে। স্থানীয় প্রভাবশালী দাদারা কিছু অন্যায় আচরন করলে, হস্তক্ষেপ করেন না। স্থানীয় পুলিশ আধিকারিকদের সাথে স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক দাদাদের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ থাকে। জিষ্ণুবাবুর ঘটনাটা সংবাদ মাধ্যমের সহযোগিতায় জানতে পারলাম। হয়তো পুলিশ এক্ষেত্রে কিছু হলেও অল্প ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবেন। আমার পরামর্শ উনি স্থানীয় পৌর মাতার সাথে যোগাযোগ করুন। এই ওয়ার্ডের পৌর মাতা অন্য ওয়ার্ডের পৌর প্রতিনিধিদের থেকে অনেকটাই আলাদা। আপনি এক্ষেত্রে ভাগ্যবান যে আপনার কাছে ওরা বাড়ির কোন অংশ দাবী করেনি! আপনার বাড়িতে কোনও অফিস ঘরের দাবী করেনি? আপনি সুবিচার পাবেন এটাই আশা করছি।”
কাঁকুলিয়ার মার্কিন নাগরিকের ঘটনায় তৃণমূল নেতা তথা আইনজীবী বৈশ্বানর চট্টোপাধ্যায়ের কাছে শুক্রবার হোয়াটসঅ্যাপে প্রশ্ন রেখেছিলাম। উত্তর পাইনি। শনিবার সকাল ৯টা ৩৮এ ফের তাঁর কাছে হোয়াটসঅ্যাপে নির্দিষ্ট প্রশ্ন রাখি। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটাতেও এর উত্তর মেলেনি।ভাঙড়ে তোলাবাজির যে ঘটনার উল্লেখ করেছি, সেই প্রসঙ্গে বৃহস্পতিবার বিচারপতি রাজাশেখর মান্থা প্রকাশ্যেই বলেন, “এই ধরণের ঘটনা মেনে নেওয়া যায় না। যিনি যত বড় ক্ষমতাশালী হোন, তদন্ত করতেই হবে। ভবিষ্যতে এমন ঘটলে জনস্বার্থ মামলা হিসাবে প্রধান বিচারপতির কাছে পাঠিয়ে দেব।”
কিন্তু জলভাতের মত সর্বব্যাপী তোলাবাজের শিকারদের ক’জনের পক্ষে হাইকোর্টে বিচার চাওয়া সম্ভব? বিষয়টা তো রীতিমত সময় এবং অর্থসাপেক্ষও বটে! কাজ নেই। দলের ছেলেদের পুষতে নেতৃত্ব যদি একমাত্র আয়ের পথ তোলাবাজিতে নামিয়ে দিতে বাধ্য হন, ভবিষ্যতে তার প্রভাব হবে ভয়ঙ্কর।