দুরন্তবার্তা ডিজিটাল ডেস্ক :সিংহের পিঠে বসা দেবীর চিত্র বহুদিন ধরেই বাঙালির চোখে পরিচিত। মহিষাসুরমর্দিনী দেবীর বাহন এই সিংহ—শক্তি ও তেজের প্রতীক। তবে কি এটি রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের শরৎকালীন পুজোর সেই একই সিংহ? সম্ভবত নয়।
কারণ, মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের চালু করা শরৎকালীন দুর্গাপুজোয় দেবীর বাহন ছিল ঘোটকমুখী সিংহ। পৌরাণিক কাহিনিতে ঘোড়ার অশ্বমেধ যজ্ঞের কথা রয়েছে। তাছাড়া যুদ্ধ সম্পর্কিত যেকোনও ঘটনায় সিংহ নয়, ঘোড়ার উপস্থিতি প্রত্যক্ষ করা যায়। তাই অসুর নিধনে দেবী ঘোটকমুখী সিংহ নিয়ে আবির্ভূতা হয়েছিলেন বলে অনেকেই মনে করে থাকেন। আর সেই কারণেই দুর্গাপুজোর প্রথম দিকে ঘোড়ামুখী এই সিংহকে দেখা যেত দেবীর বাহন রূপে।
ঘোটকমুখী সিংহ বলতে বোঝায় শরীরের আকৃতি সিংহের মতো হলেও মুখটি ঘোড়ার। পরাধীন ভারতবর্ষে বহু বাঙালি বাড়ির পুজোতেই দেখা মিলত এই ঘোটকমুখী সিংহের। মনে করা হয়, এই ঘোড়া ছিল ব্রিটিশ বাহিনির প্রতীক। কালের বিবর্তনে এই ঘোড়ামুখী সিংহ আজ হারিয়ে গেছে। এটিই ছিল দেবীর প্রথমদিকের বাহন। পরে ঘোড়ার মুখের জায়গায় আসে আসল সিংহের মুখ। যদিও কলকাতার মিত্রবাড়িতে এখনও সেই প্রাচীন ধারা অনুসৃত হয়। এমনকী কৃষ্ণনগরের রাজবাড়িতেও সিংহের মুখ অশ্বসদৃশ। কিন্তু কেন? কেন সিংহবাহিনীর বাহনের মুখে অশ্বের ছাপ?
মহেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর ‘কলিকাতার পুরাতন কাহিনী ও প্রথা’ গ্রন্থে জানাচ্ছেন, এটা আসলে বৈষ্ণববাড়ির প্রতিমার বৈশিষ্ট্য। যদিও কালীঘাটের পটে আঁকা কিংবা উনিশ শতকের কাঠখোদাই ছবিতেও এমন ঘোড়ামুখী সিংহের দেখা মেলে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এখানে রয়েছে একটা অন্য কারণ। ১৮৬৬ সালে আলিপুরে চিড়িয়াখানা স্থাপিত হয়। দল বেঁধে সেখানে গিয়ে বাঙালি প্রত্যক্ষ করে সিংহকে। তার আগে পর্যন্ত সুজলা সুফলা বঙ্গদেশে হলদে-কালো ডোরাকাটা বাঘই ছিল সর্বেসর্বা। সিংহকে চাক্ষুষ করার সুযোগ হয়নি। আর সেই কারণেই এর আগে শিল্পীরা তাঁর কল্পনায় পশুর মাথায় কেশর বসিয়ে দিতেন বটে, কিন্তু সিংহের মুখের অবয়ব তাঁদের অধরাই ছিল। কালক্রমে এটা হয়ে ওঠে একটা বিশেষ স্টাইল। যে ধাঁচের সিংহ আজও কোথাও কোথাও রয়ে গিয়েছে দেবী দুর্গার পাশে।
আজকের থিমসর্বস্ব পুজোয় অবশ্য নানা এক্সপেরিমেন্টই দেখা যায়। মোটামুটি ভাবে গত শতকের ছয়ের দশক থেকেই তা লক্ষ করা গিয়েছিল। কিন্তু নতুন সহস্রাব্দে এসে তা নতুন মাত্রা পায়। নানা পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্যে ফিরে ফিরে এসেছে একচালা প্রতিমাও। এভাবেই পুরনো সময় ফিরে এসে নতুনের বুকে জায়গা করে নেয়।