দূরন্ত বার্তা ডিজিটাল ডেস্ক: উত্তরবঙ্গ টানা বৃষ্টিতে বিপর্যস্ত। শনিবার থেকে প্রবল বর্ষণের কারণে বিভিন্ন এলাকায় ভূমিধস এবং সেতু ভেঙে যাওয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থা ব্যাপকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়েছে। এ পর্যন্ত ২৫ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে মিরিক ও সুখিয়াপোখরিতে। তবে সোমবার সকাল থেকে পরিস্থিতিতে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে, পাহাড়ি এলাকায় বিশেষভাবে বৃষ্টি কমে যাওয়ায় পরিস্থিতি ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণের দিকে যাচ্ছে।
তবে সাম্প্রতিক দিনের ছবি দেখে অনেকেই উত্তরবঙ্গের সফর বাতিল করেছেন। একাধিক এলাকায় সেতু ভাঙা এবং ধসের কারণে সমতল থেকে পাহাড়ে ওঠার প্রধান রাস্তাগুলি বন্ধ হয়ে গেছে। যে রাস্তাগুলি এখনও চলাচলের উপযোগী, সেখান দিয়েও যেতে হচ্ছে দীর্ঘ ঘুরপথে, যার ফলে সময় অনেক বেশি লাগছে। তাই অনেকেই ভ্রমণের ঝামেলার কথা ভেবে মন বদলে ফেলেছেন, কেউ কেউ এখনও সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। আবার কিছু ভ্রমণকারী সফর বাতিল না করে গন্তব্য পরিবর্তনের পরিকল্পনা করছেন। চার-পাঁচ দিনের ছুটিতে তারা এমন বিকল্প জায়গার খোঁজ করছেন, যেখানে ধস বা আটকে পড়ার ঝুঁকি কম থাকবে। চলুন দেখে নেওয়া যাক এমন কয়েকটি বিকল্প স্থান।
দেওমালি: ওড়িশার সর্বোচ্চ শৃঙ্গ দেওমালি। বৃষ্টির জল পেয়ে পূর্বঘাট পর্বতমালা এখন ঘন সবুজ। তাই এই সময় ঘুরে আসতে পারেন ওড়িশার কোরাপুট জেলা থেকে। কোরাপুটেই রয়েছে দেওমালি। এখানে এলে দেখতে পাবেন প্রকৃতির সজীব রূপ। পাহাড়, উপত্যকা, ঝর্না, নদী, মন্দির ছড়িয়ে রয়েছে এই স্থানে। কোরাপুট শহর থেকে দেওমালির দূরত্ব প্রায় ৭০ কিলোমিটার। সবচেয়ে বড় ব্যপার হল, যে রূপের জন্য উত্তরবঙ্গে যাওয়া, তার প্রায় সবটাই পাবেন এখানে। বৃষ্টিস্নাত কোরাপুটের রূপ ভুবন ভোলানো। পাহাড়ের গায়ে ভেসে বেড়ায় মেঘেরা। এখান থেকেই ঘুরে নিতে পারেন ছোটবেলায় পাঠ্যবইতে পড়া ডুডুমা জলপ্রপাত। কোরাপুট থেকে মাচকুণ্ড রোড ধরে গেলে দূরত্ব পড়বে ৭০ কিলোমিটার। ডুডুমা সংলগ্ন মাচকুণ্ড জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রটিও ঘুরে নিতে পারেন। এই বছর বর্ষার স্থায়িত্ব বেশি বলেই জলপ্রপাত জলে টইটম্বুর। ডুডুমা আসার পথে ঘুরে নিতে পারেন আর এক দ্রষ্টব্য গুপ্তেশ্বর মন্দির। অরণ্যের মধ্যে গুহায় শিবলিঙ্গ। জায়গাটি আর পাঁচটি মন্দিরের চেয়ে আলাদা। রোমাঞ্চের স্বাদ নিতে চাইলে গুহাপথে পাড়ি দিতে পারেন। এখান থেকে ঘুরে নেওয়া যায় কোলাব ড্যাম এবং শবর শ্রীক্ষেত্র। পাহাড়ের কোলে প্রতিটি জায়গাই সুন্দর। তবে এই স্থানের সৌন্দর্য উপভোগ করতে হলে একটি রাত থাকতেই হবে দেওমালিতে। সেখানে যাওয়ার পথে ক্যাফেতে কফি খেয়ে ঘুরে নিতে পারেন কফির বাগিচা। এখানকার বাঁকে বাঁকে পাবেন অজনা নদী, ঝর্না। এখানে রাস্তা বেশ চও়ড়া এবং মসৃণ। দেওমালিতে পাহাড়ের মাথায় রয়েছে ওড়িশা সরকারের নেচার ক্যাম্প। সেখান থেকে চারপাশ দেখলে একটুকরো স্বর্গই বোধ হবে।
কী ভাবে যাবেন? হাওড়া থেকে রাতের সম্বলেশ্বরী এক্সপ্রেস ধরে পরদিন পৌঁছন কোরাপুট। কোরাপুটে একটি দিন থেকে যেতে পারেন। সেখানে থেকে আশপাশ ঘুরে নিতে পারেন। না হলে কোরাপুটে কয়েকটি দ্রষ্টব্য স্থান ঘুরে চলুন দেওমালি। সেখানে এক থেকে দু’টি দিন শুধুমাত্র প্রকৃতি উপভোগের জন্যই রাখতে পারেন। কলকাতা থেকে কোরাপুটের দূরত্ব প্রায় ৯৫০ কিলোমিটার। সড়কপথেও ঘুরতে ঘুরতে সেখানে যাওয়া যায়। বিমানে ভুবনেশ্বর এসে বাকিটা সড়কপথেও আসতে পারেন। ভুবনেশ্বর থেকে দেওমালির দূরত্ব ৪৬৪ কিলোমিটার।
জবলপুর: প্রবল গর্জনে ঝাঁপিয়ে পড়া ধুয়াঁধর আর রঙিন মার্বেলের চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য নিয়ে অপেক্ষা করছে মধ্যপ্রদেশের জবলপুর। ট্রেন, গাড়ি এবং বিমানপথে এখানে আসা যায়। মধ্যপ্রদেশের অন্যতম জনবহুল শহর জবলপুর। অনেকে বলেন, 'জব্বল' আরবি শব্দ। এর অর্থ পাথর। আবার অনেকে বলেন, ঋষি জাবালি নাকি এই স্থানে এসে নর্মদার তীরে তপস্যা করেন। সেই জাবালির নাম থেকে এই স্থানের নাম হয়েছিল জবলপুর। এখানেই রয়েছে রানি দুর্গাবতীর দুর্গ, ব্যালেন্সিং রক, চৌষট্টি যোগিনী মন্দির। তবে জবলপুরে যে দুই জায়গা না দেখলেই নয়, তা হল ধুয়াঁধর জলপ্রপাত ও মার্বেল রক। ৩০ মিটার উঁচু থেকে প্রবল জলরাশি যখন পাথুরে জমিতে আছড়ে পড়ে, তৈরি হয় প্রবল বাষ্প। চারপাশ যেন মনে হয় ধোঁয়ায় ভরে উঠেছে। সেই থেকেই এর নাম ‘ধুয়াঁধর’। ‘ধুয়াঁ’ হল বাষ্প আর ‘ধর’ হল প্রবাহ। বর্ষায় সেই রূপ হয়ে ওঠে অনবদ্য। তবে বর্ষা শেষেও কয়েকটি মাস সেই জলস্রোত পাওয়া যায়। জলপ্রপাতের সৌন্দর্য উপভোগ করা যায় রোপওয়েতে। ধুয়াঁধর যদি ভাল লাগার এক নাম হয়, তা হলে আর এক নাম অবশ্যই মার্বেল রক। ধুয়াঁধরের অদূরে ভেদাঘাটেই রয়েছে মার্বেল রক। ৮ কিমি বিস্তৃত গিরিখাতের সৌন্দর্য মনোগমুগ্ধকর। 'অশোক' থেকে হৃত্বিকের 'মহেঞ্জোদরো', অসংখ্য হিন্দি ছবির শুটিং হয়েছে মার্বেল রক-এ। কোথাও দুধসাদা পাথর, কোথাও তার রং গোলাপি, কোথাও আবার গায়ে লেগেছে হলুদের ছোঁয়া। মার্বেল পাথরের সেই খাতের মধ্যে দিয়ে বয়ে গিয়েছে নর্মদা নদী। রয়েছে নৌবিহারের ব্যবস্থাও। তবে মার্বেল রকের অপূর্ব সৌন্দর্য সবচেয়ে ভাল উপভোগ করা যায় পূর্ণিমা রাতে। জবলপুরে থাকার বিভিন্ন মানের হোটেল আছে।
কী ভাবে যাবেন? হাওড়া, শিয়ালদহ থেকে ট্রেনে জবলপুর যাওয়া যায়। শক্তিপুঞ্জ এক্সপ্রেস, হামসফর এক্সপ্রেস ছাড়াও কয়েকটি ট্রেন আছে। আকাশপথেও যেতে পারেন জবলপুর। এখানে রয়েছে বিমানবন্দর। সড়কপথেও জবলপুর যাওয়া যেতে পারে।
তুলিন: উত্তরবঙ্গের সফর বাতিল করে দূরে নয়, কাছাকাছি কোথাও যেতে চাইলে চলুন অদেখা পুরুলিয়া দেখতে। তিন-চার দিনে ঘুরে নিতে পারেন ঝালদার আনাচকানাচ। ঝালদা মহকুমার বিভিন্ন প্রান্তেই ছড়িয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। মাথা চ্যাপ্টা পাহাড়, টিলা, অরণ্য, জলাধার, নদী, ইতিহাস। ঝালদা সফর শুরু করতে পারেন তুলিন দিয়েও। বাংলা-ঝাড়খণ্ড সীমানাবর্তী ছোট্ট গ্রাম তুলিন। বয়ে গিয়েছে সুবর্ণরেখা। মুরী জংশন থেকে গাড়িতে পৌঁছোনো যায় সেখানে। তুলিন রেল স্টেশনও আছে অবশ্য। এখান থেকেই ঘুরে নেওয়া যায় একাধিক বাঁধ, ঝর্না। তবে যদি কোথাও যেতে ইচ্ছা না করে তা হলে অলসযাপনেও প্রকৃতির সান্নিধ্য মন্দ লাগবে না। গাছগাছালি ঘেরা শান্ত স্থান ভুলিয়ে দেবে শহুরে জীবনের ক্লান্তি।
আর যদি মন চায়, বেরিয়ে পড়তে পারেন গাড়ি নিয়ে। বাইক নিয়েও অনেকে পুরুলিয়ার আনাচকানাচ উপভোগ করেন। তুলিন থেকে ২৩ কিলোমিটার দূরে মুরুগুমা জলাধার। পাহাড় ঘেরা মুরুগুমা দেখতে আর পাঁচটি জলাধারের চেয়ে আলাদা লাগে। মনে হয়, পাহাড়ের অংশবিশেষের ফাঁক দিয়ে যেন এঁকেবেঁকে গিয়েছে জলাধারটি। অরণ্যঘেরা স্থানটি অত্যন্ত মনোরম।
অযোধ্যা পাহাড়কে কেন্দ্র করেও ঘোরা যায় দুই তিনটি দিন। পাখি পাহাড়, মার্বেল লেক, বামনী ফলস, আপার-লোয়ার ড্যাম, ছৌ মুখোশের গ্রাম চড়িদা-সহ একাধিক জায়গা আছে ঘোরার জন্য। অযোধ্যা পাহাড়, মুরুগুমা, তুলিন-সহ একাধিক জায়গায় হোটেল, রিসর্ট এবং হোম স্টে রয়েছে।
কী ভাবে যাবেন? ঝালদা হয়ে যেতে হলে মুরী জংশন স্টেশনে নামুন। হাওড়া থেকে রাতের ক্রিয়াযোগ এক্সপ্রেস ধরলে ভোর চারটে নাগাদ পৌঁছবেন মুরী জংশন। এ ছাড়াও রাঁচী শতাব্দী, রাঁচী ইন্টারসিটি, রাঁচী বন্দে ভারত-সহ একাধিক ট্রেন আছে মুরী যাওয়ার জন্য। মুরী থেকে তুলিনের দূরত্ব সড়কপথে ৫ কিলোমিটারের মতো। সড়কপথেও যাওয়া যায়।কলকাতা থেকে খড়্গপুর, টাটা, পুরুলিয়া শহর হয়ে অযোধ্যা পাহাড় গেলে দূরত্ব পড়বে ৩০০ কিলোমিটার। তুলিন অথবা পুরুলিয়া শহরে রানিগঞ্জ হয়ে কিংবা বাঁকুড়া দিয়েও যাওয়া যায়। কোন পথে যাচ্ছেন, তার উপর দূরত্ব নির্ভর করছে।