দুরন্ত বার্তা ডিজিটাল ডেস্কঃ চতুর্দিকে বেজে চলেছে ধামসা, মাদল, ঢোল। গাওয়া হচ্ছে অহিরা গীত। মাঠের মধ্যে পোঁতা আছে শাল কাঠের একটা খুঁটি। সেখানে বাঁধা রয়েছে একটি গরু, বলদ কিংবা মহিষ-জাতীয় গবাদি পশু।দেখা গেল গবাদি পশুগুলির সারা গায়ে অনেক সজ্জা, মানে আলু কিংবা লাউ কেটে আলতায়, নীল বা সবুজ রঙে চুবিয়ে তা দিয়ে গোল, বাঁকা নানা বিধ ছাপ দেওয়া। খুরের পাশে আলতা পরানো, শিং-এ তেল। গলায় বেলপাতা কিংবা গাঁদাফুলের মালা। তাকে এনে মাঠের একধারে একটা খুঁটিতে বেঁধে রেখে বিভিন্নভাবে উত্যক্ত করে তোলা হচ্ছে তাদের। আর মুখের সামনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে গবাধি পশুর শুকনো চামড়া। রেগে গিয়ে নিরহ প্রাণীটিও চেহারা নিচ্ছে আক্রমণাত্মক। শুক্রবার এরকমই এক উৎসব গরুখুঁটায় মাতল বাঁকুড়া জেলার গ্রমীন এলাকার মানুষজন। বাঁধনা পরব এর একটি অংশ গরুখুঁটা। প্রাচীন এই প্রথা কে ঘিরে জেলার গ্রামীণ এলাকায় এদিন কার্যত সাজো সাজো রব।
ছবি সৌজন্যে : anandabazar.com
কার্তিকী অমাবস্যা থেকেই বাঁকুড়া জেলার আদিবাসী, কুড়মী, সাঁওতাল, লোধাদের কৃষিভিত্তিক উৎসব ‘বাঁদনা’ শুরু হয়। তবে মূলত আদিবাসী উৎসব হলেও প্রায় সমগ্র জেলাতেই পালিত হয় বাঁদনা। আর এই উৎসবেরই একটি অঙ্গ হয়ে গেছে এই প্রথাটি। পরিচিত গরুখুঁটা বা কাড়াখুঁটা নামে। জেলার জঙ্গলমহল রানিবাঁধ, রায়পুর,সারেঙ্গায় উৎসাহ ছিল সবচেয়ে বেশি। মূলত, ভাইফোঁটার পরের দিনই বাঁকুড়ায় পালিত হয় গরুখুঁটা বা কাড়াখুঁটা। গরু, মহিষ প্রভৃতি গবাধি পশুদের গায়ে দেওয়া হয় রঙিন ছাপ। করা হয় পুজোও। এরপর নির্বাচন করা হয় তাদের মধ্যে বলিষ্ঠদের। খুঁটিতে বেঁধে পালিত হয় গরুখোঁটার রীতি। রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় এর পত্রিকা স্থান পেয়েছিল গরু খুটা বা কাড়া খুটা উৎসব প্রবাসীর ১৩২৫ সালের মাঘ মাসের এক সংখ্যায় প্রকাশিত হয় বাঁধনা তথা এনিয়ে তথ্যসমৃদ্ধ শ্রী পরেশনাথ মুখোপাধ্যায়ের একটি প্রবন্ধ লেখক লেখেন 'ইহাই তাহাদের বাঁধনা পরব অথবা কেহ কেহ কারা কোটা গরু খুটা বলিয়া থাকে' এই উৎসব কৃষককূলের কর্মবহুল শ্রান্ত জীবনে নতুন উচ্ছ্বাস উত্তেজনা এই প্রবন্ধ প্রকাশের প্রায় ১০১ বছর পার হলেও এখনো বাঁকুড়ার গ্রামে গ্রামে বিশেষত জঙ্গলমহলের এই উৎসবের উদ্দীপনায় খামতি নেই। জানা যায় এই সংস্কৃতির কারন হিসেবে লুকিয়ে রয়েছে এক অন্য গল্প।
কেনো পালিত হয় এই উৎসব ?
যে গল্প জানতে গেলে পিছিয়ে যেতে হবে বহু বছর আগের আগে৷ বহু বছর পূর্বে শাল-পলাশের ছায়া ঘন হয়ে সন্ধে নামত। জীববৈচিত্র্যে ভরপুর শিখরভূমিতে তো আর হিংস্র পশুর অভাব ছিল না। রাত হলেই কৃষিজীবি মানুষজনের গোয়ালে হানা দিত বাঘ, ভালুকের মতো শিকারি পশুরা। ফলে প্রায়শই খুঁটিতে বাঁধা অবস্থাতে প্রাণ যেত গবাদি পশুদের। এমন অতর্কিত আক্রমণ থেকে গবাধি পশুকে বাঁচানোর উপায় খুঁজতেই প্রচলন হয়েছিল গরুখুঁটার। পরে অবশ্য এই উৎসব বজায় থাকলেও উদ্দেশ্য কিছুটা বদলে যায় শীতের পূর্বে কৃষিকাজের জন্য গরু, মহিষ কতটা প্রস্তুত তারি শক্তি প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে এই উৎসব পালিত হয়ে আসছে খুঁটিতে বাঁধা অবস্থাতে গৃহপালিত জীবটিকে আত্মরক্ষার কৌশল রপ্ত করানোর জন্য উদ্ভব হয়েছিল এই উৎসবের। একটি চামড়ার খণ্ড মুখের সামনে বারবার আন্দোলিত করেই তাই উত্তেজিত করা হয় তাদের। চারপাশে চিৎকার, বাজনা এবং গান। গৃহস্থবাড়িতে হঠাৎ হিংস্র পশুর আক্রমণ হলে ঠিক যে পরিস্থিতি তৈরি হত, অনেকটা অনুরূপ পরিস্থিতি তৈরি করা হয় উৎসবে। উদ্দেশ্য, হঠাৎ আক্রমণে ভীত না হয়ে গৃহপালিত পশুটি প্রতিআক্রমণ করে আত্মরক্ষা করতে পারে। গরু বা মহিষকে উত্তেজিত করার জন্য একসময় ব্যবহৃত খোদ বাঘ বা ভালুকের চামড়া। তবে আজ সেসব দুর্লভ। ফলে গবাধি পশুর শুকনো চামড়া দিয়েই করা হয় সেই কাজ।
জীব ও প্রকৃতি বন্দনা
অত্যাচার নয়, এই রীতির ভিতরে লুকিয়ে রয়েছে এক স্নেহের পরত। শরৎ শেষে হেমন্তের বিকেলে, বাঁদনার সময়, মানভূম কৃতজ্ঞচিত্তেই বন্দনা করে এই জীবগুলির। যারা কৃষিকাজে, জীবনধারণে এই মানুষগুলোকে বছরভর শ্রম দিয়ে এসেছে, তাদের নিরাপত্তার জন্য ধামসা-মাদলের রবে, কৃষক কানে হাত দিয়ে সুর ধরেন অহিরার। শেখান আত্মরক্ষার মন্ত্র। বাঁকুড়া শহর লাগোয়া নবজীবনপুর গ্রামেও এদিন চলে অনুষ্ঠানটি। মূলত বিকেলের মধ্যেই হয় অনুষ্ঠানটি তবে। কৃষিভিত্তিক এলাকায় অত্যাধুনিক বৈদুতিক মেশিন, ট্রাক্টর, ব্যবহারের ফলে গবাদি পশুর পালনের সংখ্যা তুলনামূলক কমে যাওয়ায় গরু খুটা উৎসবের সংখ্যাও অনেক কমেছে বলে জানান স্থানীয়রা।