১৯৪৭ সালে দেশভাগের ঠিক আগে, মহম্মদ আলি জিন্নাহ্ করাচিতে ঘোষণা করেছিলেন— পাকিস্তানে অ-মুসলমানদের থাকবে সমান অধিকার ও ধর্মপালনের স্বাধীনতা। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, পাকিস্তানে অ-মুসলমানদের জন্য টিকে থাকা হয়ে দাঁড়াল কঠিন চ্যালেঞ্জ। পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্পপতি ও জমিদারদের একটি বড় অংশ ছিলেন হিন্দু ও শিখ। দেশভাগের পর, এই ধনী হিন্দু-শিখদের তাড়িয়ে তাদের সম্পত্তি দখল করা হয়েছিল। পাকিস্তানে বসবাসকারী মোহাজির (ভারত থেকে যাওয়া মুসলমান) ও পাঞ্জাবি মুসলমানরা আর্থিকভাবে দুর্বল ছিলেন। ধর্মীয় পরিচয়ের দোহাই দিয়ে শ্রেণিগত লড়াইকে তীব্র করা হয়, যা ইসলামি জাতীয়তাবাদকে শক্তি জুগিয়েছিল।
পাকিস্তানে মুসলমানের সংখ্যা ৯৮% হয়ে গেলেও শুরু হলো ভেতরেই বিভাজন। আহমদিয়া সম্প্রদায়কে অ-মুসলমান ঘোষণার পাশাপাশি শিয়া-বিরোধী হিংসা ও বাঙালি মুসলমানদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসাবে দেখার প্রবণতা ছিল প্রকট। এই প্রক্রিয়া সুন্নি পাঞ্জাবিদের একচেটিয়া আধিপত্যের দিকে নিয়ে যায়। ভারতের মতো একটি শিক্ষিত, প্রশাসনিক অভিজ্ঞ মধ্যবিত্ত শ্রেণি পাকিস্তানে গড়ে ওঠেনি। মুসলিম সমাজে শিক্ষায় পিছিয়ে থাকা ও জমিদারি-নবাব সংস্কৃতির আধিপত্যের কারণে পাকিস্তানের প্রশাসনিক কাঠামো দুর্বল থেকে যায়। ফলে রাষ্ট্র গঠনের দায়িত্ব পড়ে মূলত সামরিক অফিসারদের উপর।
১৯৫৮ সালে আয়ুব খানের হাতে পাকিস্তানে শুরু হয় সামরিক শাসন। এরপর জিয়াউল হক ১৯৭৭ সালে ক্ষমতা দখল করে জোরদারভাবে শুরু করেন রাষ্ট্রের ইসলামিকরণ। ফৌজে রোজা-নমাজ বাধ্যতামূলক করা হয়, সুরা নিষিদ্ধ হয়, আর ফৌজের মূল আদর্শ হয় “জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ”। শিক্ষাক্ষেত্রেও যুক্তিবাদ দূরে ঠেলে ধর্মকেন্দ্রিক পাঠ্যক্রম চালু হয়। এই সংস্কৃতি ধর্মীয় মৌলবাদকে প্রসারিত করে। ১৯৭৯ সালে সোভিয়েতদের আফগানিস্তান আগ্রাসন পাকিস্তানের জন্য পরিণত হয় “শাপে বর”-এ। আমেরিকার আর্থিক সাহায্যের বিনিময়ে পাকিস্তান আফগান মুজাহিদদের আশ্রয় ও অস্ত্র দেয়। এই সময়েই পাকিস্তানে বিভিন্ন দেওবন্দি মাদ্রাসা, যেমন হাক্কানিয়া, থেকে গড়ে ওঠে তালিবান। ১৯৯৬ সালে তারা আফগানিস্তান দখল করে।
তালিবান-মডেল অনুসরণ করে পাকিস্তানে গড়ে ওঠে লস্কর-এ-তৈবা, জয়েশ-এ-মহম্মদ, হিজবুল মুজাহিদিনের মতো কাশ্মীর-কেন্দ্রিক জঙ্গি সংগঠন। পাশাপাশি, লস্কর-এ-ঝাংভি, জয়েশ-উল-আদিলের মতো গোষ্ঠীরা শিয়া মুসলমানদের টার্গেট করে। পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় শিয়ারা তৈরি করে সিপাহ-এ-মহম্মদ। পাকিস্তানের জনসংখ্যার ৫১% পাঞ্জাবি মুসলমান এবং ১৪ বছরের নিচে প্রায় ৩৭% নাগরিক। দরিদ্র, অশিক্ষিত, বেকার এই যুবসমাজকে কাজে লাগায় ইসলামি মৌলবাদ। অর্থের অভাব ও ‘শহিদ’-এর মর্যাদা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা তাদের ঠেলে দেয় জঙ্গি সংগঠনগুলোর দিকে।